পাগলীর বেশে বীরাঙ্গণা


 

পাগলীর বেশে বীরাঙ্গণা (সুজন দাস)

আমি সদ্য এইচএসসি পাস করে মামার বাসায় বেড়াতে গেছি। মামার বাসা ময়মনসিংহ শহরে। বাসায় ত সবাই খুশি। কারন এই প্রথম আমি তাদের বাসায় গেছি। আমি অবশ্য যেতে চাইনি। তবুও মামার অনুরোধে আমাকে যেতেই হল। আমার দুইজন মামাত ভাই আছে। বড়জনের নাম অপু আর ছোটজনের নাম টিপু। অপু আমার বড় আর টিপু আমার ছোট। ২/৩ দিন হয়ে গেল আছি তাদের বাসায়। এখন আর ভাল লাগতাছে না। দুই ভাই কেউ বাসায় থাকে না। আর আমারও একা একা বাসায় থাকতে ভাল লাগতাছিল না। আমি টিপুকে বললাম চল আজকে শহর দেখে আসি। ও আমাকে বলল আজ না কাল শুক্রবার আছে, কাল না হয় যাব। আমি বললাম টিক আছে। আমি আর বেশি কিছু বললাম না। কারণ তারা ব্যস্ত মানুষ।পর দিন টিপু আমাকে ডেকে বলল রেডি হও ঘুড়তে যাব। আমি আনন্দের সাথে রেডি হলাম। মামি বলে দিল বেশি দেরি করিছ না। তারাতারি ফিরে আসতে। আমরা প্রথমত গেলাম বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ে। সেখানকার ক্যাম্পাস অনেক সুন্দর।ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হল। সেখান থেকে সরাসরি চলে আসলাম জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায়। তারপর গেলাম মিনি চিড়িয়াখানায়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে অবশেষে গাঙ্গীনাপাড় এসে থামলাম। আমি ক্ষুধার্থ ছিলাম তাই সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে কিছু খেলাম। পরে আমি বললাম চল স্টেশনের দিকে যাই। আমরা হেটে হেটে রেল স্টেশনের দিকে গেলাম। স্টেশন টাও অনেক সুন্দর। ময়মনসিংহ বিভাগের সকল রেলের সংযোগ ঘটেছে এইখানে। একটু দক্ষিণ দিকে এগুতেই দেখি কিছু এতিম পোলাপান শুইয়া আছে এবং তাদের পাশে তাদের মাও বসে আছে। এর থেকে আর একটু দূরে দেখি আর একজন পাগল মহিলা বসে কি যেন বলতাছে। বয়স অনুমান ৬০ হবে। কেন জানি আমার উনাকে দেখে পাগল পাগল মনে হল না।আমি মহিলার কাছে যেতে চাইলাম। টিপু বলল-যেও না। ঐ মহিলার কাছে কেউ যেতে পারে না। সবাই কে গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তুু তবুও আমি গেলাম। সাথে টিপুও।আমি ঐ পাগলীকে দেখেই বুঝে গেছি যে ও অনাহারী। তাছাড়া আমি জানতাম পাগলের সাথে ভাল ব্যবহার করলে,তারাও ভাল ব্যবহার করে। তাই আমি তার জন্য একটা রুটি আর একটা পানির বোতল কিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু অবাক করার বিষয় যে পাগল আমাদেরকে কোন গালিগালাজ করতাছে না। আমার দেওয়া খাবার সে আপন মনে খেতে লাগল। এই পাকে আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, আপনি কি পাগল। উত্তরে সে কিছুই বলে নি। আমি আবার জিগ্যেস করলাম। আবারও সে নিরব।একটু বসতে পারি? আমি জিগ্যেস করলাম। সে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।ওর খাওয়া শেষ হলে আমাকে আমাকে জিগ্যেস করল, তর বাড়ি কোথায়? আমি জবাব দিলাম। নেত্রকোনা আমার বাড়ি।এখানে আমি মামার বাসায় বেড়াতে এসেছি। এই যে ছেলেটি সে আমার মামাতো ভাই। সে আবার জিগ্যেস করল, তর নাম কি? আমি আমার নাম বললাম। আমি বললাম, আপনি কে?সে হাসল। আর বলল, আমি, পাগল। পাগলে কি এত সুন্দর করে কথা বললে পারে। আমি জিগ্যেস করলাম। উত্তরে সে হাসল। আমি আর একটা কিছু বলতে যাব তখনি, এখন তুই যা। আমাকে একটু ঘুমাতে দে তো বাচা। যা এখন তুই যা। এই বলে সে চাদর গা দিয়ে শুইয়ে পড়ল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। পাগল মানুষ কি না কি বলে ফেলে। তাই আমি সেখান থেকা কেটে পড়লাম। বাসায় এসেও আমার চিন্তার শেষ হল না। মামি ভাত বেরে আমাকে ডাকছে। এইসব যেন আমার কানে ডুকে না। কি যেন একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।আমি মামিকে জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা মামি পাগলে কি সুন্দর করে কথা বলতে পারে। মামি বলল পাগলে কি করে সুন্দর করে কথা বলবে। ওদের ত কোন উসজ্ঞান নেই। এইসব জিগ্যেস করতাছছ কেন। না এমনি। আমি আর কিছু জিগাইলাম না। এর পর দিন সকালে কাউকে কিছু না বলে আবার চলে গেলাম স্টেশনে। আমাকে দেখে, কিরে বাচা এত সকালে এখানে কেন এসেছিস। আমি জানতে চাইলাম,আপনি কি পাগল। হ্যা, আমি আবারও বললাম। কিন্তুু কিছুতেই যেন বলতে চাইছে না। তাই আমি আজকেও ব্যর্থ হলাম। ফিরে গেলাম বাসায়। মামি আমাকে জিগ্যেস করল, এত সকাল সকাল কই গেছিলি। কাউকে ত কিছু বলে যেতে পারতি। তর চিন্তায় আমরা অস্থির। এইত একটু ঘুরতে গেছিলাম মামি। এবার খাইতে দাও ভীষন খুদা লেগেছে। পর দিন আমি আবার গেলাম। গিয়ে জনতে চাইলাম- এবার সে আমার উপর বিরক্ত হল। এবং আমাকে সে গালিগালাজ করতে শুরু করে দিল। গালিগালাজ করতে করতে একসময় সে কেদে ফেলল। আমি বুজতে পারলাম তার ভিতরে অনেক কষ্ট। আমি কাছে গিয়ে বসলাম। এবং মাথা হাত ভুলিয়ে দিলাম। তুই কেন আমার সম্পর্কে জানতে চাস। আমার সম্পর্কে জেনে তর কি লাভ। তোমাকে দেখলে আমার কেমন জানি একটা মায়া কাজ করে। কিছু করতে পারি আর নাই পারি তোমার কষ্টের কথা শুনতে ত পারব। কি হবে আমাদের মত মানুষের কথা শুনে। তবুও তুমি বল আমি শুনতে চাই। লাভ নাই শুধু শুধু কষ্ট পাবি। কিন্তুু আমি ত শুনবই। সে আবারও রেগে গেল, এবং বলল শুনতে চাস আমি কে? তাহলে শুন- আমি পাগল নই। পাগলের অভিনয় করি। আমি একজন বীরাঙ্গণা। কিন্তু আমার গায়ে লেখা নেই যে আমি বীরাঙ্গণা। গায়ে লেখা নেই বলে আমাকে আজ এই জায়গায়। যাদের গায়ে লেখা আছে তারাই একমাত্র বীরাঙ্গণা। তারাই আজ ভাল খায়,ভাল পরে । আরে এই রকম আরও কত যোদ্ধা,বীরাঙ্গণা আছে যারা তাদের টিকিট মুল্যহীন ভেবে ফেলে দিছিল। তাদের আজ আমার মত অবস্থা। আমরা হিন্দু ছিলাম বলে রাজাকাররা পাক-বাহিনী নিয়ে এসে আমার মা বাবা ভাই সকলকেই আমার চোখের সামনে গুলি করে মেরেছে। আর আমাকে করেছে ধর্ষিত। সেই দিন আমি পারতাম মরে গিয়ে সব দুঃখ মুছে ফেলতে কিন্তু প্রতিসোধের আসায় কাদে বন্দুক তুলে নিয়েছিলাম। যুদ্ধকরেছি ১১নং সেক্টরে। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকেই কিন্তু আমার আস্তানা হয়েছে এই স্টেশনে। যারা এই দেশটাকে হানাদারের কাছে বিক্রয় করে দিয়েছিল তারাই আজ সমাজে উচ্চ আসনে বসে আছে। আমাদের কথা কেউ মনেই রাখে নি। তার কথা গুলো শুনে আমার চোখ থেকে আপনে আপনে জল পরতে শুরু করে দিল। শুধু অবাক করে চেয়ে রইলাম। সেইদিন তাকে বলার মত কোন ভাষা আমার ছিল না। চুপচাপ স্বার্থপরের মত সেখান থেকে উঠে গিয়েছিলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks

নবীনতর পূর্বতন